চলচ্চিত্র Wiki
Advertisement

পৃথিবীকে আমি খুব বীভৎস, কুৎসিত এবং ভয়ংকর একটা জায়গা হিসেবে দেখি। প্রকৃতি আমাকে মুগ্ধ করে না, তবে মাঝেমাঝে ভীত করে তোলে। এজন্যই হয়তো একটি সুন্দর সকালের চেয়ে আমাকে আগ্নয়েগিরির ভয়ালদর্শন অগ্নিস্রোত বেশি টানে। আমি বুঝে গেছি, পৃথিবীতে নির্মল সুন্দর বলতে কিছু নেই। সকালের উদীয়মান আলোর সাথে আমি ইঙ্গমার বারিমান এর মতই কষ্টকর সেক্স এর মিল খুঁজে পাই। এই পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু নির্মল তার সবই মানুষের সৃষ্টি। প্রকৃতিতে এর কোনটাই ছিল না। মানুষের এই সৃষ্টির নাম আর্ট। বাংলা “শিল্প” শব্দটি আমার কখনোই ব্যবহার করতে ইচ্ছে করে না। কারণ বাংলায় ইন্ডাস্ট্রি আর আর্ট এই দুই শব্দের প্রতিশব্দই শিল্প। এই বিশ্রী সাযুজ্য কোন বাঙালি কবে তৈরি করেছিল তাকে একবার সামনে পেতে ইচ্ছে করে। কষে একটা ঝাড়ি লাগাতাম। ফাইজলামির আর জায়গা পায় না। কোথায় ইন্ডাস্ট্রি আর কোথায় আর্ট। এই দুই বিপরীতমুখী ধারার প্রতিশব্দ এক হয় কী করে?

প্রকৃতিতে যদি সুন্দর কিছু থেকে থাকে তবে সেটা মানুষ সুন্দর বলেছে বলেই সুন্দর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের চেতনার রঙে যেমন পান্না রং পেয়েছিল ঠিক তেমনই প্রকৃতির প্রতিটি কুৎসিত জিনিস আমাদের চেতনার রঙে রঞ্জিত হয়। এই রং উঠিয়ে নিলে বেরিয়ে আসবে কাটা কাটা চাকাওয়ালা ট্রাকের ঘর্ষণে জর্জরিত একটা মাটির সড়ক। সৌন্দর্য্য যা তা এই মানুষেরই, রং যা তা কেবল আমাদেরই। এই ভয়াবহ রকমের শূন্য, অসীম, বারন মহাবিশ্বে সৌন্দর্য্য সৃষ্টির মাধ্যমেই আমরা টিকে আছি। এটা না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব থাকতো না।

পিংক ফ্লয়েড এর ৬ টি গান নিয়ে করা “পিংক ফ্লয়েড: লাইভ অ্যাট পম্পেই” সিনেমা দেখে এই মহাদর্শনই আবার মনে পড়লো। চলচ্চিত্রের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্যের কথা বললে এটাকে সিনেমা বলা যায়। তাছাড়া সিনেমার এডিটিং, ভিজ্যুয়াল স্টাইল কোনকিছুই স্ট্যান্ডার্ড ছিল না। এডিটিং এ আদিম যুগের মিউজিক ভিডিওর প্রভাব আমাদের উপহাস করেছে। তারপরও কেবল দুটো জিনিস এটা দেখতে আমাকে সাহায্য করেছে:

  1. পম্পেই শহর
  2. পিংক ফ্লয়েড এর গান

৭৯ সালে ভিসুভিয়াস এর লাভাস্রোতে ডুবে গিয়েছিল পম্পেই। শহরের মানুষেরা যে যেখানে ছিল সেভাবেই মমিতে পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘ ১৭০০ বছর পর ১৭৪৮ সালে অবশেষে আমরা এই শহরের সন্ধান পেয়েছি। এই শহর যেন একটি জান্তব শেক্সপিয়ারিয়ান ট্র্যাজেডি। শিল্পের সাথে যারা বাস্তবের মিল খুঁজে পায় না তাদের উচিত একবার পম্পেই ঘুরে আসা। আমি নিজেও অবশ্য ঘুরে আসি নি। আর এ কারণেই বোধহয় পিংক ফ্লয়েড এর কাছে ঋণের পরিমাণটা বেড়ে গেছে। এখানেও শিল্পের মাধ্যমে বেঁচে থাকার অদম্য প্রেরণাটা পরিপূর্ণ মাধুর্য্য নিয়ে উঠে এসেছে।

পিংক ফ্লয়েড এর গান যে কাউকে একটি ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। অনেকটা স্ট্যানলি কুবরিক এর সিনেমার মতো। তারা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, যেই জগতে আছো সেটাকে অতি বাস্তব মনে না করারও অবকাশ আছে, যে অস্তিত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো সে অস্তিত্বকে অস্বীকার করেও টিকে থাকা যায়। পম্পেই এর এই ট্র্যাজেডি নিয়ে ডেভিড গিলমোর বা রজার ওয়াটার্স রা কিভাবে বেঁচে থাকতো? শিল্প চেতনা আরেকটু বেশি হলে আমি নিজেও তো বেঁচে থাকতে পারতাম না। পম্পেই এর অন্ধকার যে বুঝেছে সে যদি তাকে ঢাকার জন্য সমপরিমাণ আলো তৈরি না করে, এবং যে আলো সে তৈরি করেছে তাতে যদি উৎস হিসেবে রয়ে যাওয়া অন্ধকারের ছাপ না থাকে তাহলে মানুষ বাঁচবে কী করে?

আলো-আঁধার এর এই খেলাই দেখলাম, গানের মাধ্যমে। সবচেয়ে ভাল লেগেছে “ইকোস” এবং “সেট দ্য কন্ট্রোলস ফর দ্য হার্ট অফ দ্য সান” গান দুটি। লিরিক-সুর দুটোই খুব ভাল। এছাড়া অন্যান্য গানগুলোতে যথারীতি খানিকটা সাইকেডেলিক এর ছাঁটে পম্পেই এর ট্র্যাজেডি ফুটে উঠতে দেখলাম। অগ্নস্রোত দেখানোর সময় ওয়াটার্স এর সাররিয়েল চিৎকার, কুকুর এর সাথে হারমনিকা বাজানোর সময় গিলমোর এর মুখভঙ্গি সবগুলোই মনে গেঁথে গেছে। ইকোস এর সময় রাইট ও গিলমোর এর বিশাল ক্লোজ-আপ এবং গান গাওয়ার ভঙ্গি ভাল লেগেছে। গানের কথা যেমন, সুর তেমন গাওয়ার ভঙ্গিও সেরকম অসাধারণ। ফাঁকে ফাঁকে পম্পেইবাসীর করা শিল্পকর্মের ছাপই দেখা যায়। তাদের ম্যুরাল, তাদের ভাস্কর্য, তাদের আঁকা ছবি। দম্পতির ছবিটা কেন জানি মন থেকে সরাতে পারছি না।

এছাড়া পম্পেই শহরের লং শটগুলো দারুণ হয়েছে। লন্ডনের স্টুডিওতে লাইটিং ভাল হলেও ব্যান্ড মেম্বারদের পারফরমেন্স দেখানোর ভঙ্গি ভালো লাগে নি। পরিচালক যে এটা করতে গিয়ে তেমন কোন কষ্ট করেন নি বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে যেটুকু ভালো লাগার তা কেবল পিং ফ্লয়েড এর জন্যই। বিশাল ড্রাম ঘিরে ওয়াটার্স এর সাইকেডেলিক উন্মাদনা ভাল লেগেছে। সিড ব্যারেট কে হয়তো মিস করেছি। এখনও ব্যারেট এর কোন পারফরমেন্স দেখতে পারি নি। কিন্তু তার ইন্টারস্টেলার ওভারড্রাইভ বা অ্যাস্ট্রোনমি ডমিনি দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত যে রজার ওয়াটার্স এতে কোন সন্দেহ নেই।

আমি আর্ট এর জগতে যতোটা নতুন, গানের জগতে তার চেয়েও নতুন। “দ্য ওয়াল” সিনেমা দেখে কিভাবে যেন পিংক ফ্লয়েড এর ভক্ত হয়ে গেলাম। অতো শত কারণ জানি না। স্ট্যানলি কুবরিক এর “আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ” যেমন বারবার দেখি পিংক ফ্লয়েড এর গানও তেমনি বারবার শুনি। মনে হয় এরাই সভ্যতার শূন্যতা, মানব জীবনের অর্থহীন বীভৎসতা, সমাজ দিয়ে মানুষকে ছেয়ে ফেলার অদ্ভুত ষড়যন্ত্রের স্বরূপ বুঝতে পেরেছিলেন। কেউ হয়ত সজ্ঞানে সেটার মোকাবেলা করেছেন, কেউ হয়তো এই অসুস্থ পরিবেশের কারণে হয়ে গেছেন উন্মাদ। তাদের উন্মাদনাকেই যে পৃথিবীর মানুষ অনেক কাল ধারণ করে রাখবে এতে আমার কোন সন্দেহ নেই।

বিষয়শ্রেণী:১৯৭২ বিষয়শ্রেণী:সঙ্গীত বিষয়শ্রেণী:মিউজিক্যাল বিষয়শ্রেণী:ইংরেজি

Advertisement